রাজধানীর নিউ মার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ী-কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের ঘটনায় একটি হত্যা মামলাসহ তিনটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে পুলিশের দুই মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় এক হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়। এজাহারে নাম উল্লেখ করা ২৪ আসামির সবাই নিউ মার্কেট থানা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা।
এ ছাড়া হত্যা মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় দুই শতাধিক ব্যক্তিকে আসামি করা হয়েছে। এই মামলার বাদী নিহত নাহিদ হাসানের চাচা মো. সাঈদ।
পুলিশ সূত্র জানায়, নিউ মার্কেট থানা পুলিশের করা একটি মামলার বাদী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবির, অন্যটির বাদী এসআই মেহেদী হাসান।
জানতে চাইলে থানার ওসি এম এ কাইয়ুম বলেন, জ্বালাও, পোড়াও, বিস্ফোরণ, হাঙ্গামা ও পুলিশের কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশের পক্ষ থেকে দুটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় ২৪ জনের নাম উল্লেখসহ অজ্ঞাতপরিচয় প্রায় এক হাজার ২০০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
বিএনপি নেতাদের আসামি করা প্রসঙ্গে ওসি বলেন, প্রাথমিক তদন্তে এই ২৪ জনের নাম এসেছে। এ জন্য তাদের আসামি করা হয়েছে। তাদের ধরতে থানা পুলিশের পাশাপাশি গোয়েন্দা পুলিশ কাজ করছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব মামলায় এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। তবে গত তিন দিনে অন্তত ৫৬ জনকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। তারা ঘটনার বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য দিয়েছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, ঘটনাস্থলের আশপাশের সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ ও জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করে এরই মধ্যে পুলিশ ৩০ জনকে শনাক্ত করেছে। তাঁদের মধ্যে নিহত দুজনের ওপর হামলার সঙ্গে জড়িত যুবকও রয়েছেন। সাংবাদিকদের লাঠি ও রড দিয়ে পেটাতে পেটাতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি টিভি ক্যামেরা ভাঙার সঙ্গে জড়িতদেরও চিহৃিত করা হয়েছে।
আসামি বিএনপি ও অঙ্গ সংগঠনের ২৪ নেতা
পুলিশের দুই মামলার এজাহারভুক্ত আসামিরা হলেন—নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি মকবুল হোসেন, থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি আমির হোসেন, সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক মিজান, ঢাকা কলেজ ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি (বর্তমানে লন্ডনে) মো. টিপু, নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী, সাবেক সম্পাদক হাসান জাহাঙ্গীর মিঠু, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হারুন হাওলাদার, থানার সাবেক নেতা শাহ আলম শন্টু, ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রদলের সাবেক সভাপতি শহিদুল ইসলাম শহিদ, থানা যুবদলের সাবেক সম্পাদক জাপানি ফারুক, যুবদলের সদস্যসচিব মিজান বেপারী, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড ছাত্রদলের আহ্বায়ক আসিফ, সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক রহমত, ছাত্রদল নেতা সুমন, বিএনপি নেতা জসিম, বিএনপি নেতা বিল্লাল, থানা যুবদলের সাবেক সভাপতি হারুন, শ্রমিক দলের সভাপতি তোহা, থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি মনির, বিএনপি নেতা বাচ্চু, ঢাকা কলেজের সাবেক ছাত্রদল নেতা জুলহাস, মিঠু, বিএনপি নেতা মিন্টু ও যুবদল নেতা বাবুল।
এরা সবাই সদ্যোবিলুপ্ত নিউ মার্কেট থানা বিএনপির নেতা। এজাহারভুক্ত এক নম্বর আসামি মকবুল নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। জানতে চাইলে তিনি দাবি করেন, ‘আমি নিউ মার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। নব্বইয়ের দশকে আমি সিটি করপোরেশন থেকে দোকান দুটি ভাড়া নিই। কিন্তু আমি কোনো সংঘর্ষের সঙ্গে জড়িত নই। গত চার মাস আমি ওই এলাকাতেই যাইনি। আমাকে রাজনৈতিক কারণে হয়রানি করতে মামলায় এজাহারভুক্ত আসামি করা হয়েছে। ’
গত সোমবার মধ্যরাতে নিউ মার্কেট দোকান মালিক ও কর্মচারীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষ হয়। রাতে সংঘর্ষ থামলেও পরদিন মঙ্গলবার দিনভর সংঘর্ষ হয়। এতে পথচারী নাহিদ হাসান ও দোকানকর্মী মোরসালিন নিহত হন। ঘটনায় অর্ধশত শিক্ষার্থীসহ আহত হন শতাধিক। এ অবস্থায় সমঝোতার লক্ষ্যে গত মঙ্গলবার দিবাগত রাতে শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী নেতাদের বৈঠকে সমঝোতা হয়।
তিন মামলা তদন্তে দেড় মাস সময়
সংঘর্ষের ঘটনায় তিন মামলায় পুলিশকে তদন্তের জন্য দেড় মাস সময় দিয়েছেন আদালত। মামলাগুলো বৃহস্পতিবার আদালতে ওঠার পর এজাহার গ্রহণ করে প্রতিবেদন দাখিল করতে ঢাকা মহানগর হাকিম শুভ্রা চক্রবর্তী আগামী ৭ জুন দিন ধার্য রাখেন।
সমঝোতার পর দোকান খুলেছেন ব্যবসায়ীরা
সংঘর্ষের কারণে টানা দুই দিন বন্ধ থাকার পর গত বুধবার রাতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেট এলাকার ব্যবসায়ীদের মধ্যে সমঝোতা হয়েছে। এরপর বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা থেকে নিউ মার্কেট এলাকার সব দোকানপাট খুলতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, স্বস্তি ফেরায় তারা আবার বেচাকেনায় মন দিচ্ছেন।
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে নিউ মার্কেট এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পরিস্থিতি অনেকটাই শান্ত। দোকান খুলেছেন ব্যবসায়ীরা। ফুটপাতেও কিছু দোকান খোলা দেখা যায়। বিশেষ করে নিউ মার্কেটসহ ঢাকা কলেজের পার্শ্ববর্তী চন্দ্রিমা মার্কেট, উল্টোপাশের নূরজাহান মার্কেট ও গ্লোব শপিং সেন্টার, চাঁদনীচক মার্কেট, গাউছিয়া মার্কেটের সামনের ফুটপাতের দোকান খোলা দেখা যায়।
সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা নিউ মার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, রাতের বৈঠকের পর পরিস্থিতি এখন শান্ত। দোকান খোলার সিদ্ধান্ত হয়েছে। সকাল ১১টার পর থেকে মার্কেটের দোকানপাট খুলতে শুরু করেন ব্যবসায়ীরা।
আমিনুল বলেন, রাতে বৈঠকে ছাত্র, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, ঢাকা কলেজ প্রশাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকে সমঝোতা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বুধবার দিবাগত রাতে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদের (সায়েন্স ল্যাবরেটরি) সভাকক্ষে সব পক্ষের মধ্যে ওই বৈঠক হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) মহাপরিচালক নেহাল আহমেদ বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন। সভা শেষে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সভায় উভয় পক্ষে সমঝোতা হয়েছে। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সকাল থেকে নিউ মার্কেটসহ এলাকার সব মার্কেটের দোকানপাট খোলা হবে।
নেহাল বলেন, ছাত্রদের দাবিগুলোর প্রায় সবই যৌক্তিক। ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এসব দাবি মানা হয়েছে। ছাত্রদের ছুটি ও হলে থাকার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কলেজ কর্তৃপক্ষ। এ জন্য শিগগিরই মনিটরিং সেল গঠন করা হবে। সংঘর্ষে তৃতীয় পক্ষের উসকানি ছিল বলেও দাবি করেন তিনি।
বেচাকেনায় স্বস্তি
সকালে নিউ মার্কেট এলাকায় দেখা গেছে, দোকান খোলার পর ক্রেতারাও আসা শুরু করেছেন। টুকটাক বেচাকেনা চলছে। ফুটপাতের ব্যবসায়ীরাও ব্যস্ত বেচাবিক্রিতে।
নিউ মার্কেট ফুট ওভারব্রিজের সামনের ফুটপাতের দোকানি রহমত বলেন, ‘এহন শান্তি আইছে। বেচাকানা হইতাছে। কাস্টমারও আইতাছে। ’
পাশের গাউছিয়ার এক দোকানি বলেন, ‘ঈদের আগে এ ধরনের সাংঘর্ষিক পরিস্থিতি আমরা আশা করিনি। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। আশা করছি, আর কোনো সমস্যা না হলে বেচাকেনা বাড়বে। ’
এ সময় সালমা আক্তার নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘সংঘর্ষের কারণে আগে আসতে পারিনি। এখন পরিস্থিতি শান্ত। তাই ঈদের কেনাকাটা করতে এসেছি। ’
বন্ধ সেই দুই ফাস্ট ফুডের দোকান
সংঘর্ষের সূত্রপাত হওয়া ওয়েলকাম ও ক্যাপিটাল ফাস্ট ফুডের দোকান বৃহস্পতিবার বন্ধ ছিল। দোকান দুটির সামনে পাহারায় ছিল একদল পুলিশ। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন থেকে বিএনপি নেতা মকবুল হোসেন বরাদ্দ পেয়ে দোকান দুটি ভাড়া দেন।
নতুনসিলেট২৪ডটকম / এএ
সম্পাদক: এসএম নাসির উদ্দিন।
উপ সম্পাদক: দেওয়ান জাকির হোসেন।
যোগাযোগ: পশ্চিম জিন্দাবাজার, সিলেট।
ই-মেইল: natunsylhetnews@gmail.com
মুঠোফোন: ০১৭১৫৫০১১৫১
এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা বা ছবি অনুমতি ছাড়া নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা সম্পুর্ন বে-আইনি।